পরলোকের প্রতি আমাদের আকর্ষণ অমোঘ। মৃত্যুর পরে যে অখন্ড অতল অন্ধকার, তাকে জানতে তাই আমাদের কৌতূহলের অন্ত নেই। কৌতূহলের সঙ্গে মিশে গেছে কল্পনা, বিভ্রান্তি এবং অনেকখানি ‘ভয়’। আর ওই ভয়কে জয় করতে সে কালের জাপানিরা একটা আশ্চর্য খেলা শুরু করেছিলেন। খেলাটার নাম ‘হায়াকুমনোগতারি কাইদান-কাই’। শুদ্ধ বাংলায় যার মানে করলে দাঁড়ায়, ‘একশোখানি উদ্ভট কাহিনীর সমষ্টি’।
খেলাটা আসলে শুরু করেছিলেন সামুরাইরা। পথচলতি অচেনা যোদ্ধারা তাদের যাত্রাপথে যখনই একে অপরের সঙ্গে বসে দুটি সুখ-দুঃখের কথা বলার অবকাশ পেতেন তখনই এই খেলাটায় মজতেন। খেলার নিয়ম খুব সহজ সরল। কিন্তু রোমাঞ্চ ষোল আনার। খেলার সময় – রাতের অন্ধকার। খেলোয়াড়ের সংখ্যা হতে পারে এক থেকে একশো’র মধ্যে যে কোনও একটি। একশো খানা মোমবাতি জ্বালিয়ে শুরু হবে খেলা। জ্বলন্ত মোমবাতিগুলোকে ঘিরে বৃত্তাকারে বসবেন খেলোয়াড়রা। একে একে তারা শোনাবেন তাদের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে থাকা সবচাইতে ভয়ানক গল্পটি। প্রতিটি গল্পের শেষে কথক নিভিয়ে দেবেন একটি করে মোমবাতির শিখা। এভাবেই যখন শেষ মোমবাতিটা নিভে যাবে, নিকষ অন্ধাকরে ঢেকে যাবে চরাচর, ঠিক তখনই নাকি অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে আসবে এক অলৌকিক প্রাণী।
খেলাটা জাপান জুড়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। সামুরাইদের হাত ধরে গল্প বলার এই অনবদ্য রীতি ঢুকে পড়েছিল সাধারণ মানুষদের ঘর-গেরস্থালীতেও। গ্রীষ্মকালের গভীর রাতে যখন গাছের পাতা একটুও নড়ছে না ঠিক সেই সময় কৃষকদের ছোট্ট ছোট্ট দল মাঠে জমায়েত হয়ে মেতে উঠতে শুরু করল গল্প বলার এই মনোরম খেলায়। এমনকি শহরের অভিজাতদের উৎসব উল্লাসের দিনগুলোতেও জাঁকজমক করে পালন শুরু হল ভৌতিক গল্প বলার এই রীতি। মুখে মুখে ঘুরে ঘুরে ওই গল্পগুলো একদিন সময়ের ঘূর্ণিঝড় এড়িয়ে ভেসে গেল কাল কালান্তরে। ওদের মধ্যে অধিকাংশই স্রেফ অমর হয়ে গেল। গান, নাটক, উপন্যাস হয়ে বেঁচে রইল কাহিনীগুলো। কয়েক’শো বছর ধরে মানুষের মনোরঞ্জনের দায়িত্ব নিল তারা।
একশো খানা গল্প এই বইতে নেই ঠিকই, তবে পুরনো জাপানের হাওয়ায় মিশে থাকা অতিপ্রাকৃত উপাদানগুলোকে কুড়িয়ে তাদের কয়েকটি পরিচিত গল্পকে সামান্য সাজিয়ে নিজের ভাষায় প্ৰকাশ করার দুর্দম ইচ্ছেটাকে চেপে রাখা ভারী মুশকিল। তাই কিছু গল্পের খোল নলচে একটু পাল্টে অথবা সম্পূর্ণ নতুন গল্প ফেঁদে একসঙ্গে একই মলাটে ধরে প্রকাশ করা হল ‘কাইদান’ বইটি। ‘কাইদান’- জাপানি ভাষায় যার মানে হল ‘ঘোরানো সিঁড়ি’- ওটা আসলে একটা রূপক। অন্তহীন পরলোকের অন্ধকারে ডুবে যাওয়ার যে কুটিল পথ, সেটাকেই বোঝায় কাইদান শব্দটি। আরেকটু সহজে, কাইদান হল ‘ভূতের গল্প’।
ভনিতা শেষ করে গল্পের প্যাঁচানো সিঁড়ি ধরে গহীন অন্ধকারে ডুবে যাবার আগে অবশ্য একটা কথা বলে রাখা জরুরি– এই বই শুধুই গল্পের বই। জাপানের ভৌতিক কাহিনী সম্পর্কে গবেষণা করার মতন জ্ঞান বা বুদ্ধি, কোনটাই আমাদের নেই। তবে গল্পগুলি পড়ে কেউ যদি সে দেশের সমাজ সভ্যতা নিয়ে বিন্দুমাত্র উৎসাহী হন এবং তাদের জীবনচর্যা সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে ওঠেন তাহলে সফল হবে এই প্রচেষ্টা।
Reviews
There are no reviews yet.